1abraham-lincoln

আব্রাহাম লিংকন একজন সাধারণ রাজনীতিবিদ থেকে কীভাবে আমেরিকার একজন সেরা রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন – তার সেই যাত্রা থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু রয়েছে। তিনি তার মূল শক্তি – ভাষার প্রয়োগ – কে তার নিজ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ নয়, বরং আমেরিকান মানুষদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি মহান হতে পেরেছিলেন।

লিংকন যে আমেরিকান রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে অন্যতম একজন সেরা বক্তা ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। একজন বক্তা, লেখক, বিতার্কিক, রসিক ও আলোচক হিসেবে তার কথাগুলো আজও আমাদের বিনোদন ও শিক্ষা দিয়ে থাকে। মাত্র এক বছরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত লিংকন ভাষা ও অভিব্যক্তির দক্ষতা নিজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন। ছোটবেলায় তিনি তার বন্ধুদের জড়ো করে উচুঁ এক স্থানে উঠে বক্তব্য রাখতেন। ইলিনয়ে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সময়, লিংকন প্রায়শই সন্ধ্যায় একটি পানশালায় তার বন্ধুদের সাথে দেখা করে গল্প বলা প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন। এবং শেক্সপিয়ারের লেখা পড়ে তিনি ভাষাগত দক্ষতা গড়ে তোলেন।

রাজনৈতিক অভিপ্রায় যখন তার মধ্যে জেগে উঠল, লিংকন দেখেন যে তিনি তার কথার শক্তি দিয়ে তার প্রতিপক্ষদেরকে কাবু করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি তাদের প্রতি কড়া সমালোচনা ছুঁড়ে দিলেন। ১৮৪০ সালে এক রাজনৈতিক সভায় তিনি তার প্রতিপক্ষ  লেস থোমাসের নকল করে তাকে মজা করেছিলেন যা দর্শকরা তুমুলভাবে করতালি দিয়ে স্বাগত জানায়।

কিন্তু যে লিংকনকে আমরা রাষ্ট্রপতি হিসেবে চিনি, তিনি কিন্তু আবেগপ্রবণ কোন রাজনীতিবিদ নন যে শুধু তার প্রতিপক্ষদের ঢালাওভাবে সমালোচনা করত। তার এই পরিবর্তনের কারণ কী হতে পারে? সব সময় তার মধ্যে একটা বিষয় কাজ করত।

তিনি শত্রু সহ অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং প্রতিকূল পরিবেশে তিনি তার এই শক্তিকেই কাজে লাগাতেন। আমেরিকাকে শাসন করার জন্য এই গুণ তার মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তখন আমেরিকা ছিল এক বিভক্ত জাতি যে সবেমাত্র গৃহ যুদ্ধ কাটিয়ে উঠেছিল। একবার তিনি আর তার স্ত্রী ম্যারি টড ওয়াশিংটনে আসলে তার স্ত্রী বলেন, এখানে তো শুধু শত্রু আর শত্রু, জবাবে লিংকন বলেন, শত্রু বলে কিছু নেই। দক্ষিণ আমেরিকানদের ব্যাপারে তিনি বলেছিলেনঃ “তাদের জায়গায় আমরা থাকলেও তাদের মতই করতাম। তাদের মধ্যে দাস প্রথা বিরাজমান ছিল বলে তারাই এর প্রচলন করে।” তার কথার শক্তি বোঝা যায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ভাষণে যেখানে তিনি বলেন, “আমরা কারো শত্রু নই, আমরা সবাই বন্ধু। আন্তরিকতায় ব্যাঘাত ঘটলেও তা যেন সম্পর্কের বন্ধনকে ছিন্ন না করে।”

ধীরে ধীরে অন্যদের প্রতি ভৎসর্না না করলেও নিজের প্রতি কিন্তু ঠিকই করতেন। একবার এক রাজনৈতিক বিতর্কে স্টেফেন ডগলাস তাকে দুই মুখো হিসেবে উল্লেখ করলে, লিংকন এর জবাবে বলেছিলেন, “সেটা দর্শকরাই বিচার করবে। আমার যদি অন্য আরেকটি মুখ থাকত, তাহলে আমার বর্তমান এই মুখ ধরে রাখার কী কোন দরকার আছে?”

ক্রমান্বয়ে লিংকন তার দিকে আসা সমালোচনার জবাবও বেশ ভালভাবে এবং কৌশলে দেওয়া শিখে ফেলেন। একবার তিনি জানতে পারলেন, সেক্রেটারি অফ ওয়ার, এডউইন স্ট্যানটন রাষ্ট্রপতির আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং রাষ্ট্রপতিকে মূর্খ বললেন। লিংকন জিজ্ঞেস করেন, সে তাকে মূর্খ বলেছে কিনা, জবাবে তাকে বলা হল, হ্যাঁ, সে দুইবার তাকে মূর্খ বলেছে। এরপর লিংকন বলেন, “ঠিক আছে, স্ট্যানটন যা মনে করেছে তাই বলেছে, আমি এখন তার কাছে গিয়ে কথা বলে জানার চেষ্টা করব সে কেন এমনটা করেছে।”

তবে নিজেকে উন্নত করা সহজ নয়, তাই রাষ্ট্রপতি হিসেবেও, লিংকন মাঝে মাঝে রাগের বশবর্তী হতেন যা তিনি তার চিঠিগুলোর মধ্যে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতেন। কিন্তু তিনি তার এই রাগ মাখানো চিঠিগুলো কখনও পোস্ট করতেন না, অনেক পরে এই চিঠিগুলো আবিষ্কার করা হয় রাষ্ট্রপতির টেবিলের ড্রয়ারে অস্বাক্ষরিত অবস্থায়। এভাবে ধাপে ধাপে লিংকন তার নিজের অধ্যবসায় এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার চরিত্র গড়ে তোলেন।

লিংকনের এই যাত্রা কিন্তু আমাদের শক্তিকে ঢালাওভাবে ব্যবহার করার জন্য নয়, বরং আমাদের শক্তিকে আমাদের ভেতরকার ভাল গুণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শাণিত করারই শিক্ষা দিয়ে থাকে।

Similar Posts

Leave a Reply